খরা—শুধু একটা শব্দ নয়, একে বলা যায় প্রকৃতির এক কঠিন পরীক্ষা। মানুষ, প্রাণী, গাছপালা—সবাই মিলে এই পরীক্ষার অংশ। বৃষ্টি থেমে গেলে, মাটি ফেটে যায়, নদীর বুক শুকিয়ে যায়, আর জীবন যেন দাঁড়িয়ে থাকে তপ্ত রোদে নিঃশ্বাস বন্ধ করে। তাই খরা মোকাবেলায় করণীয় জানা মানে শুধু একটা প্রবন্ধ পড়া নয়—এটা আমাদের টিকে থাকার পাঠ।
খরা আসলে কী
খরা হচ্ছে এমন এক বিপর্যয়, যখন দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হয়, ফলে পানির স্বাভাবিক সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। এটি কখনও এক মাস, আবার কখনও পুরো বছরজুড়েও চলতে পারে। খরার কারণে নদী-খাল শুকিয়ে যায়, মাটির আদ্রতা হারিয়ে যায়, আর কৃষিজমি পরিণত হয় ফাটল ধরা মরুভূমিতে।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল—বিশেষ করে রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলাগুলো—খরার কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি। এখানকার বৃষ্টিপাত কম, আর ভূগর্ভস্থ পানিও ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে।
খরার কারণ
খরা শুধু প্রকৃতির খেয়াল নয়, মানুষের হাতও এতে গভীরভাবে জড়িত।
-
অতিরিক্ত গাছ কেটে ফেলা, ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়।
-
অপ্রয়োজনীয় ভবন ও ইটভাটা নির্মাণ, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।
-
পুকুর, খাল ও জলাশয় ভরাট করা, ফলে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
-
কলকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, যা তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
-
নদীতে বাঁধ নির্মাণ, যেমন ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারাজ, যার ফলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কমে যায়।
খরার কারণে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়
খরা মানেই সমস্যা আর দুর্ভোগের লম্বা তালিকা—
-
বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় না, ফলে পানির সংকট দেখা দেয়।
-
গবাদি পশুর খাদ্য মেলে না, চারণভূমি শুকিয়ে যায়।
-
ফসলের মাঠে পানি না থাকায় কৃষক পড়ে বিপাকে।
-
মাটির আদ্রতা কমে যায়, ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
-
নানা রকম রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে, যেমন ডায়রিয়া ও কলেরা।
-
শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে যায়, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
খরা কত প্রকার
আবহাওয়াবিদরা খরাকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন—
-
চরম খরা: টানা ১৫ দিন বৃষ্টি না হলে।
-
আংশিক খরা: টানা ২৯ দিন অতি অল্প বৃষ্টিপাত হলে।
-
আবহিক খরা: নির্দিষ্ট ঋতুতে বৃষ্টিপাত ৭৫% কমে গেলে।
-
জলজ খরা: নদীর স্রোত কমে গেলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।
-
কৃষিজ খরা: মাটির আদ্রতা হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হয়।
-
আর্থসামাজিক খরা: পানি সংকটে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
খরার ফলাফল
খরার প্রভাব শুধু মাঠে নয়, সমাজের প্রতিটি কোণে পড়ে—
-
কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন কমে যায়, ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
-
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্প ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে ক্ষতি বাড়ে।
-
পরিবেশে গাছপালা মরে যায়, প্রাণী হারায় বাসস্থান।
-
মানুষের স্বাস্থ্যে দেখা দেয় নানা সমস্যা।
-
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও বেড়ে যায়।
খরা মোকাবেলায় করণীয়
খরা ঠেকাতে আমাদের হাতে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ রয়েছে। এগুলো কেবল সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বও বটে।
-
পানি ব্যবহারে সচেতনতা: যতটুকু দরকার, ততটুকুই পানি ব্যবহার করা উচিত।
-
গভীর চাষাবাদ: জমি চাষের সময় মাটি গভীর করে করলেই আর্দ্রতা বেশি দিন থাকে।
-
পুকুর ও খাল খনন: জলাধারগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যেন বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়।
-
জৈব সার ব্যবহার: রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণমান ভালো থাকে।
-
বেশি বেশি গাছ লাগানো: গাছ শুধু ছায়া দেয় না, মাটির জলধারণ ক্ষমতাও বাড়ায়।
-
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: বৃষ্টির সময় ছাদ বা খোলা জায়গায় পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা উচিত।
-
নলকূপ স্থাপন: গভীর নলকূপের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা।
-
জমিতে আগাছা পরিষ্কার রাখা: এতে ফসল পর্যাপ্ত পানি পায় এবং উৎপাদন বাড়ে।
মানুষের দায়িত্ব
প্রকৃতি একা খরা সৃষ্টি করে না—আমরাও কম দোষী নই। তাই আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জলাশয় ভরাট বন্ধ করতে হবে, বৃক্ষনিধন কমাতে হবে, আর পানি ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।
আমার ভাবনা
খরা মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য একটাই—আমরা যেন সচেতন হই। খরা রোধ করা কঠিন, কিন্তু প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব নয়। আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপই পারে একটি বড় পরিবর্তন আনতে।
যদি আপনি এই লেখাটি পড়ে কিছুটা চিন্তা করেন, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় সাফল্য। খরা কেবল প্রকৃতির রাগ নয়—এটা আমাদের অসচেতনতার ফলও। তাই আসুন, সবাই মিলে একসাথে বলি—খরা নয়, সবুজ হোক জীবন।
