ভাবুন তো—একদিন সকালে দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন মুখের ভেতরে এক অদ্ভুত দাগ বা ছোট্ট একটা ঘা! প্রথমে মনে হলো, আহা, হয়তো পান-সুপারি খাওয়ার কারণে একটু ঘষা লেগেছে। কিন্তু কয়েক দিন পরেও সেটা সারছে না! এই জায়গাতেই কিন্তু সাবধান হওয়া দরকার। কারণ, এমন ছোট্ট ঘা-ই হতে পারে মুখের ক্যান্সারের প্রথম সংকেত।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক ও ওর্যাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. নাদিমুল হাসান জানিয়েছেন—মুখগহ্বরের ক্যান্সার, যাকে আমরা বলি ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসার, আসলে আমাদের মুখের বিভিন্ন অংশেই হতে পারে। ঠোঁট, জিহ্বা, গালের ভেতর, মাড়ি, মুখের তালু কিংবা গলার নিচের অংশ—সবই এর শিকার হতে পারে।
মুখ ক্যান্সারের আসল গল্পটা কী?
ডা. এম নিজামুল হক ব্যাখ্যা করেন, আমাদের মুখকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়—
একটি হলো সামনের অংশ (Oral Cavity Proper), আরেকটি পেছনের অংশ (Oropharynx)।
এই দুই জায়গার যে কোনো অংশে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটলেই শুরু হতে পারে ক্যান্সারের যাত্রা।
প্রাথমিক পর্যায়ে মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ
ডা. নাদিমুল হাসান জানান, মুখের ক্যান্সার শুরু হয় প্রায় নিঃশব্দে—
প্রথমে হয়তো দেখা দেয় একটা ব্যথাহীন মাংসপিণ্ড বা ঘা, যা সহজে সারতে চায় না। এরপর দেখা দিতে পারে—
- ঢোক গিলতে কষ্ট
- কথা বলতে অসুবিধা
- জিহ্বা নড়াতে ব্যথা বা টান
- মুখের ভেতরে অস্বাভাবিক দাগ বা ফোলাভাব
এই উপসর্গগুলোকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে মুখের ক্যান্সার সহজেই চিকিৎসা করা সম্ভব।
তখন কী করবেন?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক বলছেন, “এমন কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে একজন রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।”
প্রথমে সাধারণ চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা করবেন। যদি সাত দিনের মধ্যেও উন্নতি না হয়, তাহলে তিনি রোগীকে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন—যেখানে সঠিকভাবে ক্যান্সার পরীক্ষা ও চিকিৎসা করা সম্ভব হবে।
মুখের ক্যান্সারের মূল কারণ
অনেকে ভাবেন ধূমপানই মুখের ক্যান্সারের একমাত্র কারণ। কিন্তু আসলে তা নয়।
ডা. এম নিজামুল হকের ভাষায়, “আমাদের দেশে ধূমপান দুইভাবে হয়—ধোঁয়াসহ এবং ধোঁয়াবিহীন।”
যেমন—
- পান, জর্দা, সুপারি খাওয়া
- দাঁতের পাশে পান জমিয়ে রাখা
এগুলো মুখের ভেতরে ক্রনিক ইরিটেশন তৈরি করে, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
আর যদি এর সঙ্গে ধূমপানও যোগ হয়, তাহলে ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েকগুণ!
দেশে মুখের ক্যান্সারের ভয়াবহতা
ডা. নাদিমুল হাসানের মতে, বাংলাদেশে মুখের ক্যান্সার এখন এক নীরব মহামারির মতো।
পুরুষদের মধ্যে এটি দ্বিতীয় এবং নারীদের মধ্যে তৃতীয় সর্বাধিক সাধারণ ক্যান্সার।
যেখানে পশ্চিমা বিশ্বে মুখের ক্যান্সারের হার মাত্র ৬-৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে এই হার ৩০ শতাংশের নিচে নয়!
মূল দোষ—সহজলভ্য ধূমপান ও পান-সুপারি সংস্কৃতি।
কীভাবে শনাক্ত হয় এই ক্যান্সার?
প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা সরাসরি দেখে আক্রান্ত জায়গার অবস্থান বোঝেন।
এরপর যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, করা হয় বায়োপসি—অর্থাৎ আক্রান্ত জায়গা থেকে একটি ছোট টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা।
ক্যান্সার ধরা পড়লে, করা হয় এক্স-রে, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই, যাতে বোঝা যায় ক্যান্সার কতটা ছড়িয়েছে।
শেষ কথা—সচেতনতার বিকল্প নেই
দুই বিশেষজ্ঞের একটাই জোরাল পরামর্শ—“ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতন হোন।”
প্রতি সপ্তাহে একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ, দাঁত, মাড়ি ভালো করে দেখে নিন।
প্রতি ছয় মাসে একবার ডেন্টিস্টের কাছে চেকআপ করুন।
দাঁতের সঠিক যত্ন নিন, পান-সুপারি ও তামাকজাত দ্রব্য থেকে দূরে থাকুন।
কারণ, ক্যান্সার যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন—
প্রাথমিক পর্যায়ে মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ চিনে ফেলতে পারলে
এর চিকিৎসা সম্পূর্ণ সম্ভব।
নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন করুন।
আপনার ছোট্ট সতর্কতা হয়তো বাঁচাতে পারে একটি জীবন।
